Friday, December 16, 2016

পরিবেশ বান্ধব স্থাপত্য

পরিবেশ বান্ধব স্থাপত্য এমন একটি সৃষ্টি যা পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে প্রাকৃতিক পরিবেশ ও সামাজিক কার্যকলাপের সাথে সামঞ্জস্য রেখে একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নির্মীত হয়। এই প্রক্রিয়ার মধ্যে প্রাকৃতিক সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি কম সাধন, পরিবেশ ও প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে নক্সা প্রণয়ন, নির্মান, উপকরণ, রক্ষনাবেক্ষণ, সংস্কার ইত্যাদি জড়িত। এটি একটি দীর্ঘ্য প্রক্রিয়া, আমি ছোট করে মূল বিষয়বস্তুগুলো আজকে তুলে ধরবো আপনাদের সামনে।
পৃথিবীর অন্য দেশগুলোর থেকে বর্তমানে আমাদের বাংলাদেশ বস্ত্রশিল্পে বহুগুণ এগিয়ে আছে। আর এই শিল্পের মধ্যে যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি লক্ষ্য করা যায় তা হলো ঝুঁকিমুক্ত শিল্প কারখানা তৈরি। বহু লোকই এখন নতুন করে তাদের শিল্প-কারখানাগুলোকে বানাচ্ছে এবং তা করতে গিয়ে একটি ব্যাপার সবার মধ্যেই দেখা যাচ্ছে যে, তারা সবাই পরিবেশ বান্ধব স্থাপত্য বানাতে খুবই আগ্রহী। এর জন্যে তারা খরচের কথা ভুলে গিয়ে কম ঝুঁকিপূর্ণ বিল্ডিং বানাচ্ছে এবং দেশি ও বিদেশি বিভিন্ন জায়গা থেকে বিল্ডিং এর সার্টিফিকেট অর্জন করছে ক্রেতাদের পরিপূর্ণ আস্থা অর্জনের জন্য। যদি তারা LEED CERTIFICATE অর্জন করতে চায় USGBC থেকে তবে তাদেরকে পরিবেশ বান্ধব স্থাপত্য বানানো জন্য কি কি প্রক্রিয়া নিতে হবে সেটাই আজকের লিখার মূল বিষয়।
পরিবেশ বান্ধব স্থাপত্যের মুল পলিসি হলো 3R এবং এই পলিসী কে বাস্তবায়ন করার জন্যে কিছু সুসংহত প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়েই যেতে হবে। সেই প্রক্রিয়াগুলো খুবই সংক্ষিপ্ত আকারে নিম্নে আলোচনা করা হলো :
      প্রথমেই অবস্থান ও পরিবহনের কথা চিন্তা করে একটি সাইট নির্বাচন করতে হবে। অনুপযুক্ত ও ভ্রমণ দূরত্ব আনেক বেশি এমন সাইটে বিল্ডিং করা থেকে বিরত থাকা উচিত। পরিবেশগতভাবে সংবেদনশীল ভুমি না ব্যবহার করা’ই ভালো এবং বিল্ডিং যেন পরিবেশের উপর কোন প্রতিকুল প্রভাব না ফেলে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। ধানী জমি ও বনাঞ্চল রক্ষা করে বিল্ডিং বানাতে হবে এবং আশেপাশের জনবসতির কথাও মাথায় রাখা উচিৎতাদের কোন ক্ষয়-ক্ষতি না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের কতটুকু সুযোগ সুবিধা আছে সাইটের আশেপাশে সেটাও বিবেচনায় এনে সাইট নির্বাচন করতে হবে।
     সাইট নির্বাচনের পর যে বিষয়ে লক্ষ্য রাখতে হবে তা হলো নির্মান প্রকৃয়ার জন্য যেই দূষণগুলো হয়ে থাকে তা কোনভাবেই সাইটকেও নোংরা করা যাবে না। ব্যবহৃত যন্ত্রাংশের অবশিষ্ট লোহার টুকড়া, টিনের টুকড়া, তারকাঁটা ইত্যাদিকে নির্দিষ্ট স্থানে আলাদাভাবে সংরক্ষণ করতে হবে। বালু ও সুরকিগুলোকে এক স্থানে রেখে চারপাশে ইট দিয়ে ঘের দিয়ে দিতে হবে যেন এদিক সেদিক ছড়িয়ে সাইট নোংরা না করে। সিমেন্টের খালি বস্তাগুলোকে নষ্ট না করে সেগুলোকে কাজে লাগানোর ব্যবস্থা করতে হবে এবং প্রতিটি কাজেরই প্রমাণ স্বরূপ ছবি তুলে নিদৃষ্ট তারিখসহ সংরক্ষণ করতে হবে। বৃষ্টির সময় সাইটের জমে থাকা পানিগুলোকে সেডিমেনটেশন ট্যাংকের মাধ্যমে সাইট থেকে বের করে দিতে হবে যেন পানির সাথে পলি মিশে চলে যেতে না পারেসাইটে ধুলোবালি যেন কম উড়ে সেই ব্যবস্থা করতে হবে এবং বড় একটি খোলা জায়গা যেন থাকে সাইটে BNBC কোড মেনে ডিজাইন করে সেই ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
    কনস্ট্রাকশন সাইটে পানির ব্যবহার একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। পানি ব্যবহারে মনোযোগী হতে হবে। সাইটের ভিতরের ও বাহিরের অতিরিক্ত পানির ব্যবহার কমাতে হবে এবং ব্যবহৃত পানিকে পরিশোধন করে পুনরায় ব্যবহার করতে হবে। পরিশোধন ছাড়া ব্যবহৃত পানি কোনভাবেই প্রকৃতিতে ছাড়া যাবে না। এতে করে প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় থাকবে না। কি পরিমাণ পানি ব্যবহার করা হচ্ছে তার একটি হিসাব রাখা অবশ্যই প্রয়োজন এবং বৃষ্টির পানি জমিয়ে ব্যবহার করার প্রবণতা বাড়াতে হবে।
          বিল্ডিং পরিচালনার খরচ কিভাবে কমানো যায়, কিভাবে একটি বিল্ডিং এর কম শক্তি অপচয় করে অধিক কাজ সম্পন্ন করা যায় এবং কিভাবে একটি বিল্ডিং এ বিকল্প শক্তির ব্যবহার করা যায়, সেই দিকে শুরু থেকেই মনোযোগী হতে হবে। প্রাকৃতিক শক্তিগুলোকে ব্যবহারের মাধ্যমে একটি বিল্ডিং পরিচালনার খরচ অনেক কমিয়ে আনা যায়। এই ক্ষেত্রেও কি পরিমাণ শক্তির খরচ হচ্ছে একটি বিল্ডিং পরিচালনা করতে তার হিসাব রাখা প্রয়োজন। তাহলেই আমরা একটি সঠিক তথ্য পেয়ে যাব কি পরিমাণ বিকল্প শক্তি ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে এবং আস্তে আস্তে শক্তির ব্যবহার কমছে; নাকি বাড়ছে? সাইটের আভ্যন্তরীন ব্যবহারের জন্য ব্যাটারি চালিত গাড়ি এবং বাই সাইকেল ব্যবহার করে আমরা অনেক যায়গাতেই পরিবহনে খরচ কমাতে পেরেছি বর্তমানে।     
    একটি নতুন বিল্ডিং বানানোর জন্য আমরা যে সমস্ত কাঁচামালের ব্যবহার করে থাকি অবশ্যই সেই কাঁচামালগুলো পুনরায় ব্যবহারযোগ্য (RECYCLE MATERIAL) হওয়া উচিত। যে সকল কোম্পানি এই কাঁচামাল সরবরাহ করে থাকে তাদের কাছ থেকে সার্টিফিকেট নিতে হবে যে তার পন্য পুনরায় ব্যবহার যোগ্য ব্যবহারের আগে এবং পুনরায় ব্যবহারের জন্য একবার ব্যবহারের পর সকল কাঁচামাল একটি নির্দিষ্ট গুদামে সংরক্ষণ করতে হবে এবং কি পরিমাণ কাঁচামাল পুন:ব্যবহৃত হচ্ছে তার ছবিসহ হিসাব রাখতে হবে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার পরিকল্পনা থাকতে হবে এবং সাইটে নির্দিষ্ট জায়গায় বর্জ্য ফেলার ব্যবস্থাও রাখতে হবে। কাঁচামাল হিসেবে সহজপ্রাপ্য এবং পরিবেশ বান্ধব কাঁচামালের ব্যবহার বাড়াতে হবে।
    পরিবেশ বান্ধব স্থাপনা তৈরির ক্ষেত্রে আমাদেরকে বিল্ডিং এর আভ্যন্তরীন পরিবেশের গুণগত মান নিশ্চিত করতে হবে। যতটা সম্ভব প্রাকৃতিক আলো-বাতাস ব্যবহার কতে হবে এবং যেখানে প্রাকৃতিকভাবে মান ঠিক রাখা সম্ভব নয় সেখানে কৃত্রিম উপায়ে হলেও ব্যবহারকারীর জন্যে একটি স্বাস্থ্যসম্মত ও আরামদায়ক পরিবেশের সৃষ্টি করতে হবে। ধোঁয়া ও গ্যাস বের হবার ব্যবস্থা রাখতে হবে এবং বাতাস যেন একদিক দিয়ে ঢুকে অপর দিক দিয়ে বের হতে পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনে ভিতরের বাতাসগুলোকে টেনে বের করে নতুন বাতাস ঢুকাতে হবে। একজন ডিজাইনারকে অবশ্যই ভ্যান্টিলেশন ডিজাইন করার সময় কি পরিমাণ বাতাস রুমের ভিতরে সঞ্চালন করা দরকার তার সঠিক হিসাব-নিকাশ করতে হবে। কত লাক্স লাইট থাকবে কোথায়, বাতাসের চাপ কত, রুমের ভিতরের তাপমাত্রা কত, অক্সিজেন কতটুকু আছে বাতাসে, আদ্রতা কতটুতু আছে ইত্যাদির নির্দিষ্ট হিসাব প্রতিনিয়তই রাখতে হবে।
একটি পরিবেশ বান্ধব স্থাপত্য তৈরির জন্যে যেমন কিছু প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়, তেমনই একটি ঝুঁকিমুক্ত বিল্ডিং বানানোর জন্য আমাদেরকে অবশ্যই বিল্ডিং এর নিয়ম নীতি, আইন-কাণুন ইত্যাদি মেনেই বানাতে হবে। নিজে নিজে বিল্ডিং না বানিয়ে অবশ্যই কোন অনুমোদিত কনসালট্যান্টের মাধ্যমে বিল্ডিং বানানো আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। আমরা সবাই আইন মেনে ঝুঁকিমুক্ত বিল্ডিং বানাবো এবং ভবিষ্যতে সুন্দর, সার্থক ও পূর্ণাঙ্গরূপে একটি বাসযোগ্য সবুজ, প্রাকৃতিক ও মনোরম পরিবেশের মধ্যে বসবাস করবো, এ’ই হোক আমাদের সকলের কাম্য .................... ।


স্থপতি মোঃ মাহামুদুর রহমান খান পাপন

মো: 01912467242.

No comments:

Post a Comment