Sunday, October 27, 2013

দরকার পরিবেশবান্ধব পর্যটন

অজানাকে জানা, অদেখাকে দেখা মানুষের চিরন্তন অভ্যাস। তাইতো কৌতূহলী মন নিয়ে মানুষ পাড়ি জমায় এক দেশ থেকে অন্য দেশে। পেটে যেমন ক্ষুধা আছে; তেমনি আছে মনেরও। কর্মক্লান্ত মন সে ক্ষুধা মেটাতে প্রকৃতির সান্নিধ্য পেতে উদগ্রিব হয়ে ওঠে। কখনো নয়নাভিরাম প্রকৃতিকে অক্ষুণ্ন রেখে, কখনো প্রকৃতি আর কৃত্রিমতার ছোঁয়া দিয়ে, আবার কখনো সম্পূর্ণ কৃত্রিমভাবে দেশে দেশে দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে পর্যটন শিল্প। এমন অনেক দেশ আছে যার প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত পর্যটন শিল্পকে কেন্দ্র করে। প্রকৃতির অনন্য লীলাভূমি, অপার সৌন্দর্যের বাংলাও পর্যটন শিল্পের এক সম্ভাবনাময় দেশ। প্রাকৃতিক, ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক আর ঐতিহ্যেও বাংলাদেশ পিছিয়ে নেই। ইবনে বতুতা, হিউয়েন সাঙ-এর মতো পর্যটকদের আগমন সেটাই প্রমাণ করে। এদেশে রয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত। আরো রয়েছে সৌন্দর্যের আধার পতেঙ্গা, পারকি, টেকনাফ, সেন্টমার্টিন ও কুয়াকাটা। পাহাড় ও দ্বীপের মধ্যে আছে রাঙামাটি, কাপ্তাই, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, মহেশখালি ও সোনাদিয়া। আরও রয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। এই বনেই বাস করে ভয়ঙ্কর সৌন্দর্যের প্রাণী বেঙল টাইগার, চিত্রা হরিণ, বানর, হনুমানসহ নানা প্রজাতির প্রাণী। রয়েছে ঐতিহাসিক স্থান ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনসমূহ। মাধবকুণ্ডু, পদ্মা নদী, বাটালী হিল, তামাবিল, হাওরসহ আরও অনেক চোখ জুড়ানো স্থান রয়েছে যা পর্যটকদের বিমোহিত করে। কিন্তু মানুষের অজ্ঞানতা, হেঁয়ালিপনা, অসচেতনতার কারণে দিন দিন বিনষ্ট হচ্ছে অনেক দর্শনীয় স্থানের পরিবেশ। দর্শনীয় স্থানগুলোতে অতিরিক্ত পর্যটকের আগমন আনন্দের সংবাদের না হয়ে দুঃসংবাদ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। যেমন দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনের ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত পর্যটক প্রতিদিন জাহাজে করে যাতায়াত করছে। অবাধে গড়ে উঠছে হোটেল-মোটেলসহ দোকান-পাট। সেন্টমার্টিন প্রবাল সমৃদ্ধ দ্বীপ হওয়ার কারণে ইট-পাথরের বহুতল ভবন নির্মাণ দ্বীপের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। প্রবাল তোলা ও বিক্রি নিষেধ থাকলেও অবাধে তা বিক্রি হচ্ছে। মাছ ধরার নৌকার নোঙর প্রবালের ওপরে ফেলায় ভেঙে যাচ্ছে প্রবাল কলোনী ও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পুরো পরিবেশ। প্রতি বছর সেন্টমার্টিন থেকে অবৈধভাবে প্রায় ৩০ হাজার প্রবাল তোলা হচ্ছে। ঘরের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য দ্বীপটির সৌন্দর্য এবং স্বকীয়তা দুটোই ধ্বংস হচ্ছে প্রতিনিয়ত। আবার অচেতন পর্যটকরা চিপসের প্যাকেট, পানির বোতল, কোমলপানীর ক্যান ইত্যাদি যথেচ্ছ ফেলে বর্জ্যের ভাগাড়ে পরিণত করছে সৈকত ও সাগরের পানিকে। রাতে উচ্চস্বরে গান-বাজনা আর হৈ-হুল্লোড়ের কারণে ভয়ে অনেক প্রাণী দ্বীপের কাছ ঘেঁষছে না। বিশেষ করে বিশ্বের দুর্লভ প্রজাতির অলিভ রিডলে টার্টল (জলপাই রঙা কাছিম) ভয়ে ডিম না পেড়ে অন্য জায়গায় চলে যাচ্ছে। ব্যাহত হচ্ছে তাদের বংশ বিস্তার। আবার অসচেতন পর্যটকরা বনের ভেতরে গিয়ে গাছ উপড়ে, পাতা ছিঁড়ে, ফুল তুলে নানাভাবে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করছে। অনেকেই নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে বনে ঘুরতে গিয়ে বন্যপ্রাণী শিকার করছে। বনের ভেতর মাইক বাজিয়ে আনন্দ-উল্লাস করছে। এতে পশু-পাখির প্রজননে বাধা পাওয়াসহ ভয় পেয়ে তারা সে স্থান ত্যাগ করছে। পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারে পানি ও পরিবেশ বর্তমানে বর্জ্যের ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। দেশের অন্যান্য সৈকতেরও একই অবস্থা। সুন্দরবনও রক্ষা পায়নি অবিবেচক পর্যটকদের অত্যাচার থেকে। সমুদ্রের পানিতে খাবারের বোতল, প্যাকেট ভাসাসহ কটকা সৈকতের বর্তমান বেহাল দশা দেখলে বিদেশি পর্যটকরা সুন্দরবনের অপার সৌন্দর্যের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। 


দেশের পরিচিতি ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আনে পর্যটন শিল্প। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী রেসপন্সিবল ট্যুরিজম বা দায়িত্বশীল ভ্রমণ এবং ইকোট্যুরিজম বা পরিবেশবান্ধব ভ্রমণের কোনো বিকল্প নেই। উন্নত বিশ্বে যে কোনো পর্যটকদের নির্ধারিত নিয়ম-নীতি বা বিধিমালার ভেতরেই ভ্রমণ সম্পন্ন করতে হয়। আমাদের দেশে সেসব নীতিমালা অনুসরণ করা হয় না বললেই চলে। এ ক্ষেত্রে সবার সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। পর্যটন শিল্পের বিকাশে অগ্রণী ভূমিকাসহ দর্শনীয় স্থানগুলোর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাই পারে পরিবেশবান্ধব পর্যটন শিল্প গড়তে।

No comments:

Post a Comment