Saturday, August 29, 2015

মুরাপাড়া জমিদার বাড়ি

মুরাপাড়া জমিদার বাড়ি

স্থপতি মাহমুদুর রহমান খান পাপন 

স্থপতি ফজিলাতুন সোনিও





ছবি: স্থপতি মো: মাহামুদুর রহমান খান পাপন

নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ থানার অতি পরিচিত একটি স্থান মুরাপাড়া জমিদার বাড়ি। ইহা ঢাকা থেকে ২৫ কি.মি. দূরে নরসিংদী রোডে অবস্থিত।
জমিদার রামরতন ব্যানার্জী মুরাপাড়া জমিদার বাড়িটি বানিয়েছিলেন। তিনি নাটোর স্টেট এর কোষাধ্যক্ষ ছিলেন এবং তার সততার কারণে একটি উচ্চ পদে উন্নীত হন। একটি উৎস থেকে আমরা জানতে পেরেছি এ বাড়িটি রামরতন ব্যানার্জী তৈরি করেছিলেন ১৮৮৯ সালে। কিন্তু অন্য একটি উৎস বলেছে, রামরতন ব্যানার্জী শুধু এই বাড়িটির ভিত্তি ও কাঠামো তৈরি করেছিলেন। কিন্তু তার মৃত্যুর পর তার পুত্র প্রতাপ চন্দ্র ব্যানার্জী ১৮৮৯ সালেই তার পুরনো বাড়ি ছেড়ে পেছনে আরো একটি প্রাসাদ তৈরি করেন।
১৯০৯ সালে জগদিশ চন্দ্র ব্যানার্জী এই ভবনটি সম্পন্ন করেন এবং নিজেই একজন জমিদার হয়ে ওঠেন। জগদিশ চন্দ্র ব্যানার্জী একজন অত্যন্ত জনপ্রিয় ব্যক্তি ছিলেন, কারণ তিনি দুই বার দিল্লীর কাউন্সিলর হিসেবে নির্বাচিত হন। জগদিশ চন্দ্র ব্যানার্জী তার শাসনামলে অনেক কিছু তৈরি করেছিলেন প্রজাদের জন্য। অন্যদিকে তিনি সেই প্রজাদের প্রতি ছিলেন অনেক কঠোর। তিনি একজন শক্তিশালী জমিদার ছিলেন। তার শাসনামলে কোন প্রজা যদি সময়মতো খাজনা না দিতো তাহলে তিনি তাদের মাথার চুল কেটে দিতেন এবং অনেক সময় তাদের ঘরবাড়ি আগুণ দিয়ে জ্বালিয়ে দিতেন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভক্তির সময় জগদিশ চন্দ্র ব্যানার্জী কলকাতা চলে যান।

স্থাপতিক নিদর্শন :
মুরাপাড়া জমিদার বাড়িটি সত্যিকার অর্থেই রূপসী অঞ্চলের একটি ল্যান্ডমার্ক। জমিদার বাড়ি পৌঁছানোর আগেই একটি মন্দির চোখে পড়ে। একটু এগুনোর পর আরো দুটি মন্দির দেখতে পাওয়া যায়। মন্দির দুটো পার হয়ে বেশ খানিকটা খোলা যায়গা। আর তারপর একটা পুকুর। পুকুরটির চারদিকে চারটি বাধাই করা ঘাট আর সীমানা দেয়াল। একটি ঘাট ছাড়া বাকি ৩টি ঘাট নতুন করে করা হয়েছে বলে মনে হয়। পুকুরটি পার হয়ে একটা মাঠ। দেখে বোঝা যায় অতীতে মাঠটি আসলে একটি বাগান ছিল। মাঠের পাশেই জমিদার বাড়িটি দাড়িয়ে। জমিদার বাড়িতে ঢুকতে হয় হাতের বা দিকে অবস্থিত একটি বিশাল আমবাগানের ভিতর দিয়ে। ওখানে বড় বড় বেশ কতগুলো পুরনো আমগাছ রয়েছে। আম বাগান পেরুনোর পরই হাতের ডানদিকে একটি বিশাল মাঠ পাওয়া যায়। আর মাঠের পরই জমিদার বাড়ি।
দৃষ্টিনন্দিত দোতলা প্রসাদটি আয়তাকার করে বানানো হয়েছে যা প্রায় ২০০ ফুট দীর্ঘ। প্রাসাদটির একটি বড়  পশ্চিমমুখী সম্মূখভাগ আছে। দোতলাবিশিষ্ট বাড়িটির সামনে দিয়ে দুটি লেভেলই ১০ ফুট চওড়া একটি টানা বারান্দা আছেএই বারান্দাটি বাড়ির প্রতিটি কক্ষে ঢোকার ও ভবনের সামনে অবস্থিত মাঠের সমস্ত কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করার জন্যে তৈরি করা হয়েছে। আরো একটি কারণ ছিলো এই বারন্দাটি তৈরি করার, তা হলো পশ্চিম দিকের রোদের থেকে মুল ভবনটিকে রক্ষা করা। এই বারান্দাটিতে রয়েছে অর্ধবৃত্তাকার আর্চ। আর্চের দুই পাশে কোরেনথিয়ান কলাম ব্যবহার করা হয়েছে। আর্চের ভিতরে কাস্ট আয়রনের কারুকার্য করা গ্রীল এবং তার সাথে লাল, নীল ও সবুজ রঙের কাঁচ ব্যবহার করা হয়েছে। যার ফলে সূর্যের আলো কাচের ভিতর দিয়ে এসে বারান্দার মেঝেকে রাঙিয়ে তোলে।
বাড়িটির মাঝখানে কোর্ট-ইয়ার্ড আছে। তাকে ঘিরেই বাড়িটির কক্ষ বিভাজন করা হয়েছে। কোর্ট-ইয়ার্ডটিতে ঢুকতে একটি বেশ বড় ভারী কারুকার্যখচিত কাস্ট আয়রনের ফটক পার হতে হয়। এই ফটকটি অন্দর মহলে ঢুকার মুল প্রবেশদ্বার। কোর্ট-ইয়ার্ডে ঢুকতেই হাতের ডান পাশের কক্ষগুলোকে রন্ধনশালা বলে মনে হয়েছে। হাতের বাম দিকের অংশটিতে একটি বেশ বড় ডাবল-হাইটেড কক্ষ। কক্ষটির দুইপাশে দুটো নিশও চোখে পড়লো। আবার ওই কক্ষটি থেকে ভেতরের ৫টি কক্ষে যাওয়া যায়। কক্ষটির সামনে বারান্দা আছে যা নকশা করা কলাম এবং আর্চ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। কক্ষগুলোতে বড় বড় ফরাসী জানালা ব্যবহার করা হয়েছে। কক্ষগুলোতে বড় বড় ফরাসী জানালা ব্যবহার করা হয়েছে এবং জানালায় ও দরজায় কাঠের লুভর ব্যবহৃত হয়েছে।
বাড়িটির দুই দিকে ২টি সার্ভিস এন্ট্রি। তবে ডান দিকের সার্ভিস এন্ট্রিটিকে মনে হয় বাড়ির অন্দরমহলের লোকেরা ব্যবহার করতো। ডান দিকের সার্ভিস এন্ট্রিটির সামনে একসময় একটি সুন্দর বাগান ছিল বলেই মনে হয়। বাড়ির বাম অংশে এবং পেছনের দিকে পরিচারক ও পরিচারিকাদের থাকার জায়গা আর একটা ফলের বাগান। বাম পাশের সার্ভিস এন্ট্রি বরাবর পেছনে আরও একটি পুকুর। সম্ভবত গৃহ পরিচারিকাদের দ্বারাই এটা ব্যবহৃত হতো। এই পুকুরটির একটিই বাঁধাই করা ঘাট। পুকুরের চারদিকে হাটার রাস্তা। আর ডান দিকটিতে ফলের বাগান।
বর্তমানে বাড়িটি মুরাপাড়া সরকারী ডিগ্রী কলেজ হিসেবে পরিচিত।